Verified By Apollo Psychiatrist October 12, 2023
10494বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, বা বিপিডি হল একটি মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি যা আপনার নিজের সম্পর্কে এবং আপনার জীবনে থাকা অন্যান্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে আপনার অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। যাদের জীবনে এটি নিয়ে অভিজ্ঞতা আছে, তারা এটিকে আবেগ, সম্পর্ক নিয়ে অস্থিরতা এবং নিজেকে নিয়ে দোদুল্যমান অনুভূতিতে পূর্ণ যেন একটা নাগরদোলা সফর — এইভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বিপিডি ব্যক্তিত্ব, স্ব-ধারণা এবং এমনকি পছন্দ এবং অপছন্দ নিয়েও ঘন ঘন মত পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
পরিত্যাগের ভয় পায়াও বিপিডি এর একটি পরিচিত লক্ষণ। বিপিডি-এর লোকেরা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক রাখতে চায়, কিন্তু তাদের মেজাজের পরিবর্তন, আবেগপ্রবণতা এবং আক্রমণাত্মক আচরণ প্রায়ই বন্ধু এবং পরিবারকে ভীত করে তোলে। অতএব, আপনি যদি বিপিডি পীড়িত হয়ে থাকেন, তবে আবেগ, আচরণ এবং সম্পর্ক এইসব সামলে চলতে অসুবিধা অনুভব করতে পারেন।
উপরন্তু, বিপিডি আক্রান্ত লোকেরা অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। তারা ক্ষুদ্রতম জিনিসের জন্যও উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। বিপিডি-এ ভুগছেন এমন ব্যক্তিদেরও নিজেকে সুস্থির অবিচলিত রাখা দুরূহ কাজ। এবং সোজাসাপ্টা চিন্তা করা এবং যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়াও তাদের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে। বিপিডি প্রায়শই প্রাপ্তবয়স্ক হবার শুরুর দিকে দেখা যায়, তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা ভালও হয়ে যেতে পারে।
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের বিভিন্ন লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে। রোগ নির্ণয়ের জন্য, মানসিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধীর চিকিৎসকরা এর উপসর্গগুলিকে 9টি ভাগে ভাগ করেছেন। কোন ব্যক্তির মধ্যে যদি এই লক্ষণগুলির অন্তত 5টি দীর্ঘ সময়ের জন্য দেখা গিয়ে, তবে তাকে বিপিডি-তে আক্রান্ত বলে ধরা হয়। নিচে বিপিডি এর লক্ষণ ও উপসর্গগুলি দেওয়া হল:
1. পরিত্যাগের ভয়
বিপিডি এর সবচেয়ে বিশিষ্ট লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হল পরিত্যাগের ভয়। বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবসময় প্রিয়জনদের থেকে দূরে চলে যাবার বা একা থাকার ভয় পান। তাই পরিবারের সদস্যদের ককর্মক্ষেত্র থেকে দেরিতে বাড়ি আসার মতো সাধারণ কিছু ব্যাপারেও এরা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ফলস্বরূপ, বিপিডি-এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিবার এবং বন্ধুদের নিজের কাছাকাছি রাখার জন্য উন্মাদের ন্যায় প্রচেষ্টা চালায়।
যদিও এই ধরনের আচরণ বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হলেও, অন্য প্রান্তের ব্যক্তির কাছে এটা যথেষ্ট ভীতিজনক। অতএব, সবাইকে কাছে রাখার চেষ্টা এই প্রচেষ্টা কিন্তু আখেরে বিপরীত প্রভাবই ফেলে, অন্য মানুষজন ভয় পেয়ে যায়। এই কারণেই বিপিডি- আক্রান্ত লোকেরা প্রায়শই নিজেকে অন্যদের থেকে একা করে ফেলে এবং তাদের এই শূন্যতার অনুভূতি প্রতিটি ব্যর্থ সম্পর্কের সাথে আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়।
2. অস্থিরকৃত সম্পর্ক
বিপিডি আক্রান্ত লোকেরা দ্রুত প্রেমে পড়ে এবং তারপরে সহজেই হতাশ হয়ে প্রেম থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। প্রায়শই, তারা একটি করে নতুন সম্পর্কে প্রবেশ করে এই আশায় যে এই নতুন ব্যক্তিটি হয়ত ক্রমাগত উদ্বেগ এবং নিরাপত্তাহীনতা থেকে তাদের কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারবে। কিন্তু যখন এটি ঘটে না, তখন সম্পর্কটা খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে এগিয়ে যায়। বিপিডি- ক্লিষ্ট লোকেদের জন্য, সম্পর্ক হয় একদম নিখুঁত বা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর কিছু; এর মাঝামাঝি কিছু নেই।
3. অস্পষ্ট স্ব-ধারণা
স্ব-ধারণা বা ভাবমূর্তি হল নিজের সম্বন্ধে থাকা একটি উপলব্ধি, আপনি নিজেকে কতটা পছন্দ করেন তা এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্থিতিশীল ভাবে কোন নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ বজায় রাখতে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। তারা একদিন নিজেদেরকে অশেষ ভালবাসা দেখায় তো পরেরদিন নিজেকে অত্যন্ত ঘৃণা করতে শুরু করে দেয়। এই ধরনের ব্যক্তিদের তারা কে এবং তারা জীবনে কী চায় এইসব সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না। তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লক্ষ্যগুলি তাদের মেজাজের সাথে সাথে সদা পরিবর্তনশীল। এবং সেই কারণেই তাদের বন্ধু, চাকরি, মূল্যবোধ, জীবনের লক্ষ্য ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটতে থাকে এমনকি তাদের ধর্ম বা যৌন পরিচয়েরও পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে।
4. স্ব-ধ্বংসাত্মক আচরণ
স্ব-ধ্বংসাত্মক আচরণ এবং আবেগপ্রবণতা বিপিডি-এর দুটি সবচেয়ে বিশিষ্ট লক্ষণ। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্ব-ধ্বংসাত্মক নানা আচরণ করে থাকে যেমন বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো, দোকান থেকে জিনিসপত্র চুরি করা, অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মাদক গ্রহণ করা, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা ইত্যাদি। এমন নানা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ তাদের সেই মুহূর্তে ভালো বোধ করতে সাহায্য করলে, এটি কিন্তু একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য, আর্থিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
5. নিজের ক্ষতিসাধন
আত্ম-ধ্বংসের পরে আত্ম-ক্ষতি আসে। বিপিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের ক্ষতি করতে কোন দ্বিধা করেন না। তারা সহজেই নিজেদের শরীর কেটে ফেলতে পারে বা নিজেকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে এবং আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে কোন পদক্ষেপও নিয়ে নিতে পারে। শরীরে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করা বা নিজেকে পুড়িয়ে ফেলা হল আত্ম-ক্ষতি সবচেয়ে পরিচিত পদ্ধতি, কিন্তু তারা নিজেদের আঘাত করার আরো অন্যান্য উপায়ও খুঁজে পেতে পারে। বিপিডি আক্রান্ত লোকেরা কখন কোন কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে নেবে, সর্বদা এমন একটা বিপদের মধ্যে থাকে। তাদের প্রিয়জনদের ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং আত্মহত্যার কোন প্রবণতা আসছে কি না সেদিকে নজর রাখতে হবে।
6. মেজাজ পরিবর্তন
বিপিডি মেজাজের চরমভাবে পরিবর্তন ঘটায়, যা আজকের সুখী-হাসিখুশি মেজাজ থেকে আগামীকাল হতাশাগ্রস্ত এবং আত্মহত্যার মানসিকতার দিকে চলে যেতে পারে। এই উপসর্গটি এই কারণে ঘটে যে বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা জীবনের ক্ষুদ্রতম জিনিসগুলিতেও উত্তেজিত হয়ে যায় এবং একটি মানসিক বিকৃতিতে চলে যায়। তাদের মেজাজের পরিবর্তন তীব্রভাবে ঘটলেও তা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মেজাজের পরিবর্তন মাত্র কয়েক মিনিট বা ঘন্টা স্থায়ী হয়।
7. শূন্যতার অনুভূতি
বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা শূন্যতার দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতিতে ভোগেন। তারা প্রায়ই, ” কারোর কেউ নয়” এমন অনুভব করে থাকে এবং এই অস্বস্তিকর শূন্যতার অনুভবটি তারা চরম এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের সাহায্যে পূরণ করার চেষ্টা করে। বিপিডি-এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা ভালো বোধ করার জন্য মাদকদ্রব্য, অনিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়া বা এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ যৌন ব্যবস্থার সাথেও জড়িত হতে পারে। শূন্যতার এই অনুভূতিটিই তাদের করা সমস্ত আচরণ এবং প্রতিক্রিয়াকে জাগিয়ে করে। তাদের সম্পর্ক, তাদের কাজ, এমনকি তাদের আগ্রাসী মনোভাবও এই শূন্যতাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে যা তারা পূরণ করতে চায়।
8. বিস্ফোরক রাগ
বিপিডি আবেগপ্রবণতা সৃষ্টি করে, যা প্রায়শই বিস্ফোরক রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামান্যতম মতবিরোধেও এদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ক্রোধের প্রবণতা দেখা যায়। বিস্ফোরক রাগ জিনিস ছুঁড়ে ফেলা বা চিৎকার করার মতো (এমনকি সর্বজনীন স্থানেও) আচরণের সাথে প্রকাশ পেতে পারে । মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকদের মতে, এই রাগ যে সর্বদা বাইরে প্রকাশ পাবে এমন নাও হতে পারে। বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভিতরে ধরে রাখতে পারে এবং পরে এটাই স্ব-ক্ষতির আকারে প্রকাশ করতে পারে।
9. প্যারানইয়া বা সন্দেহ
বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই প্যারানিয়ার সাথে লড়াই করে। তারা প্রায়ই অন্য লোকেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে এবং তাদের কুয়াশাচ্ছন্ন এবং দিশেহারা বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনা নিয়ে তাদের স্ত্রীর জীবন দুর্বিষহ করে দিতে পারে। বিপিডি -এর রোগীরা যখন চাপের মধ্যে থাকে তখন প্রায়ই বাস্তবতার সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের কষ্ট দেয়।
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের কারণ
মানসিক স্বাস্থ্যবিদরা বিশ্বাস করেন যে বিপিডি জিন ঘটিত এবং ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার মতো বাহ্যিক কারণগুলির সংমিশ্রণের কারণে ঘটে। আসল কারণগুলি এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি। গবেষণা এবং স্টাডিতে দেখা গেছে যে পার্সোনালিটি সংক্রান্ত ব্যাধিগুলি উত্তরাধিকারসূত্রে বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থাকা নানা মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাধিগুলির সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হতে পারে।
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের নির্ণয় ও তার চিকিৎসা
অন্যান্য সমস্ত পার্সোনালিটি সংক্রান্ত ব্যাধিগুলির মতো বিপিডি ও, নির্ণয় করা হয় এর সাহায্যে:
বিপিডি প্রধানত সাইকোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়, তবে একজন ডাক্তার লক্ষণগুলি পরিচালনা করার পরিকল্পনায় এরসাথে ওষুধ যোগ করতে পারেন। একজন ডাক্তার যদি আত্ম-ক্ষতি বা আত্মঘাতী আচরণ শনাক্ত করেন তবে হাসপাতালে ভর্তি করার সুপারিশও করতে পারেন।
আপনার বা আপনার পরিচিত কারোর মধ্যে বিপিডি এর লক্ষণ দেখা যয় তবে তাদের উপেক্ষা করবেন না।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
অধিক্রমণ লক্ষণগুলির কারণে বিপিডিকে বেশ কয়েকটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে ভুল করা যেতে পারে। এগুলি হল:
বিচ্ছিন্নতা বিপিডি এর প্রধান লক্ষণগুলির মধ্যে একটি। বিপিডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে চাপের সময় এটি পরিলক্ষিত হতে পারে। বিচ্ছিন্নতাও তীব্র স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং সেইসাথে পিটিএসডি -এর একটি লক্ষণ, উভয়ই বিপিডি-এর সাথে ঘটতে পারে।
সহানুভূতির অভাব সাধারণত বিপিডি তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এই ধরনের ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন বলে মনে হতে পারে এবং প্রিয়জনের কাছে মানসিক এবং শারীরিক উভয় বেদনারই কারণ হতে পারে।
যদি এটির চিকিৎসা না করা হয় তবে বিপিডি বিধ্বংসী রূপ নিতে পারে। লক্ষণগুলি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে এবং এর ফলে চাকরি হারানো, জটিল সম্পর্কে জটিলতা, গুরুতর আত্ম-ক্ষতি এবং আরও অনেক কিছুর মতো পরিবর্তন জীবনে হতে পারে।
লক্ষণগুলি দেখে আপনি বলতে পারেন একজন ব্যক্তির বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রয়েছে কি না। বিপিডি-এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই তীব্র মেজাজের পরিবর্তন, প্যারানিয়া, আবেগপ্রবণতা এবং আচরণে চরম পরিবর্তন এর মতো লক্ষণ দেখায়।
The content is verified by our Psychiatrists to ensure evidence-based, empathetic and culturally relevant information covering the full spectrum of mental health