সামগ্রিক ধারণা
মলদ্বারে রক্তক্ষরণ একটি সুপ্ত রোগের উপসর্গ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মলদ্বারে রক্ত ক্ষরণের সমস্যার নিজে থেকেই সমাধান হয়ে যায়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসাগত সাহায্যের প্রয়োজন হয়। যদি আপনার মলদ্বারে প্রচণ্ড রক্তপাত হয়, তবে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন কারণ এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর রোগ হতে পারে।
মলদ্বারে রক্তক্ষরণ কী?
যেসব রোগীদের মলদ্বারে রক্ত ক্ষরণ হয়, তাদের পায়ু দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়। এই রক্ত রোগীর মলে উপস্থিত থাকতে পারে বা টয়লেট পেপারে থাকতে পারে। কিছু কিছু সময় রক্ত খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু মলের পরীক্ষা করার পর রক্ত নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায়।
মলাশয় বা মলদ্বার থেকে এই রক্তপাত হতে পারে। মলদ্বারে রক্তপাতের ক্ষেত্রে রক্তের রং উজ্জ্বল হতে পারে বা গাঢ় মেরুন রঙের হতে পারে। রক্তের রং রক্তের নির্গমন স্থানকে নির্দেশ করতে পারে। উজ্জ্বল লাল রঙের রক্ত নিম্ন মলাশয় বা মলদ্বারের রক্তক্ষরণকে বোঝায় আর গাঢ় লাল রং মলাশয় অথবা ক্ষুদ্রান্ত্রের রক্তক্ষরণকে বোঝায়। কালচে বা আলকাতরা রঙের মল পাকস্থলী থেকে রক্তপাতকে বোঝায়।
মলদ্বারে রক্তপাতের উপসর্গ কী?
মলদ্বারে রক্তপাত যুক্ত রোগী নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি অনুভব করতে পারেন:
- মলদ্বারে ব্যথা বা চাপ: রক্তপাতের অন্তর্নিহিত কারণের জন্য রোগীর মলদ্বারে ব্যাপক ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- রক্তমাখা মল:মলত্যাগের সময় রোগীর প্রচুর পরিমাণে মলদ্বার থেকে রক্তপাত হতে পারে।
- পেটে ব্যথা: মলদ্বারে রক্তপাতের কারণে কিছু কিছু রোগীর পেটে টান ধরতে পারে এবং ব্যথা হতে পারে।
- রক্তপাতজনিত উপসর্গ: যেসব রোগীদের প্রচুর রক্তপাত হয়, তারা প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যান দুর্বলতা ক্লান্তি এবং নিম্ন রক্তচাপ থাকে। গুরুতর ক্ষেত্রে রোগীরা শক খেতে পারেন এবং তাদের তৎক্ষণাৎ চিকিৎসাগত সাহায্য প্রয়োজন হয়।
মলদ্বারে রক্তপাতের কারণ কী?
এইরকম তো কারণ আছে, এর মধ্যে কিছু হল:
- হেমারয়েড: এটি পাইলস নামে পরিচিত। যেসব রোগীর রোগ আছে তাদের পায়ুর রক্তবাহে প্রদাহ তৈরি হয়। হেমারয়ডের জন্য রক্তপাত হতে পারে। যে বিষয়গুলি হেমারয়েডের ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে তোলে, তা হল স্থূলত্ব, গর্ভাবস্থা, গুরুতর ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য।
- ফিসার: মলদ্বার, মলাশয় অথবা পায়ুর কলাপ্রাচীর ছিঁড়ে যাওয়ার জন্যও মলদ্বারে রক্তপাত হতে পারে।
- কোলাইটিস: মলাশয়ের মধ্যেকার কলার প্রদাহ হয় কখনো কখনো। এই রোগটি কোলাইটিস নামে পরিচিত। আলসেরাটিভ কোলাইটিসের কারণে আলসারের বৃদ্ধি বা কোলনে ঘায়ের জন্য রক্তপাত হতে পারে।
- ফিসচুলা: কোনো কোনো সময় পায়ু এবং ত্বক অথবা পায়ু এবং মলাশয় ও মলদ্বারের মত দুটি অঙ্গের মধ্যে একটা কিছু খুলে যায়। এর কারণে রক্তপাত হতে পারে।
- ডাইভার্টিকুলিটিস: যখন মলাশয়ের পেশির স্তরে দুর্বলতা তৈরি হয়, তখন একটা ছোট পকেট তৈরি হয়। এই রোগটির নাম ডাইভার্টিকুলিটিস। ডাইভার্টিকুলিটিস রোগের কারণে রক্তপাত হতে পারে।
- পলিপ: পলিপ হল কলার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। কখনো কখনো পলিপের কারণে রক্তপাত, বিরক্তি এবং ব্যথা বোধ হতে পারে।
- গ্যাস্ট্রোএন্ট্রেরাইটিস: যেসব রোগীরা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, বিশেষত, মলাশয় অথবা পাকস্থলীতে সংক্রমণের জন্য রক্তপাত হতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ রক্তপাত: গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল অঙ্গের আঘাতের জন্য অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হয়।প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের জন্য চিকিৎসা সাহায্য দরকার।
- যৌনভাবে সংক্রামিত রোগ: কখনো কখনো যৌনভাবে সংক্রামিত রোগ পায়ু বা মলাশয় অঞ্চলে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।
- ক্যান্সার: মলাশয় বা মলদ্বারের ক্যান্সারা আছে এমন রোগীর মলাশয় থেকে রক্তপাত হতে পারে। কোলোরেক্টাল ক্যান্সার আছে এমন প্রায় 48% মানুষের মলাশয় থেকে রক্তপাত হতে পারে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
কখনো মলাশয় থেকে রক্তপাত এবং এই সম্পর্কিত অন্যান্য উপসর্গগুলিকে অবহেলা করবেন না। নিম্নলিখিতগুলো যদি আপনি অনুভব করে থাকেন, তবে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন:
- আপনার রক্তপাত হতে পারে দুই থেকে তিন সপ্তাহের জন্য থাকতে পারে।
- মলত্যাগের অভ্যাস এর ক্ষেত্রে আপনি একটি হঠাৎ পরিবর্তন সম্ভব হতে পারেন।
- আপনি দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব করবেন এবং প্রশ্নাতীত কারণে ওজন হতে পারে।
- পেটের মধ্যে ব্যথা হবে।
- আপনার গলাতে পারে এবং বমি হতে পারে।
- আপনার পেটে গোটা অনুভব হতে পারে।
মলাশয় থেকে রক্তপাত কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
মলাশয় থেকে রক্তপাতকে প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু কিছু হল:
- প্রচণ্ড কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার ব্যবস্থা করা। আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার ব্যবস্থা করবেন।
- স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য খান। তন্তুসমৃদ্ধ খাদ্যকে আপনার খাদ্যাভ্যাসে যুক্ত করুন।
- যথেষ্ট পরিমাণে তরল পদার্থ পান করে নিজের শরীরকে আর্দ্র রাখুন।
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল তন্ত্রকে যে খাদ্য গুলি ব্যাহত করে তা খাবেন না, যেমন মশলাদার এবং ভাজা খাদ্য।
- একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা।
- যৌনভাবে সঞ্চারিত রোগ প্রতিরোধ রোধ করার জন্য যৌন সঙ্গমের সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন।
- মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ দেবেন না।
ডাক্তার কিভাবে মলাশয় থেকে রক্তপাতকে নির্ণয় করেন?
মলাশয় থেকে রক্তপাতকে নির্ণয় করার জন্য ডাক্তারের কাছে বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। তাদের মধ্যে কিছু হল:
- বিশদে পরীক্ষা: মলাশয় রক্তপাতের কারণ নির্ধারণ করার জন্য ডাক্তার আপনাকে সম্পূর্ণ পরীক্ষা করতে পারেন। ডাক্তার আপনাকে অনেক প্রশ্ন করতে পারেন এবং তার মধ্যে আপনার চিকিৎসাগত এবং পারিবারিক ইতিহাস অন্তর্গত।
- কোলোনোস্কোপি: মলাশয় এবং মলদ্বারের অস্বাভাবিকতাকে পরীক্ষা করার জন্য ডাক্তার কোলোনোস্কোপি করতে পারেন। এটি মলাশয় থেকে রক্তপাতের কারণ নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।
- সিগময়ডোস্কোপি: সিগময়ডোস্কোপি হলো একটি পরীক্ষা যা মলাশয় এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের নিচের অংশে পরীক্ষা করে এবং ক্যান্সার ও মলত্যাগের অন্যান্য অস্বাভাবিকতাগুলিকে নির্ধারণ করতে পারে। সিগময়ডোস্কোপ ব্যবহার করে ডাক্তার এই পরীক্ষা করেন।
- মলে সুপ্ত রক্ত পরীক্ষা: আপনার মলে কোনো রক্তের উপস্থিতি আছে কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য ডাক্তার এই পরীক্ষাটি করতে বলতে পারেন।
- বায়োপ্সি: যদি ডাক্তার ক্যান্সার সন্দেহ করেন তবে তিনি বায়োপসি করতে বলবেন বায়োসের জন্য ডাক্তার ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ থেকে পরীক্ষার জন্য একটি ছোট কলা বার করে নেবেন।
- প্রতিচ্ছবির কৌশল: কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে সিটিস্ক্যান বা আল্ট্রাসাউন্ড করতেও পরামর্শ দেবেন।
মলাশয় থেকে রক্তপাতের জন্য চিকিৎসার বিকল্প গুলি কী কী?
মলাশয় থেকে রক্তপাত, এর কারণের ওপর নির্ভর করে। কিছু কিছু চিকিৎসার বিকল্পগুলি হল:
- ব্যাপক কোষ্ঠকাঠিন্য এবং হ্যামারয়েডের কারণে রক্তপাত: ডাক্তাররা রোগীকে তন্তু সমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে বলেন, নিতম্ব-স্নান এবং মল নরম করার জন্য কিছু ওষুধ দেন।
- পায়ুপথে ফাটলের কারণে রক্তপাত: কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ওষুধ দিয়ে ডাক্তাররা পায়ুপথের ফাটলকে ঠিক করেন। ডাক্তাররা মলত্যাগের পর পায়ু অঞ্চলকে আলতো করে মুছে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
- অন্যান্য কারণে রক্তপাত: যদি ক্যান্সার রক্তপাতের কারণ হয়, তবে ডাক্তাররা কেমোথেরাপি বা সার্জারির পরামর্শ দেবেন। তাঁরা ক্রোহনের রোগ যুক্ত রোগীদের কর্টিকোস্টারয়েড দিতে পারেন।
উপসংহার
রোগীদের কখনো মলাশয় থেকে রক্তপাতকে অবহেলা করা উচিত নয়। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব। এই রোগের জন্য কোন চিকিৎসার সুপারিশ করার আগে ডাক্তাররা এর কারণ নির্ধারণ করেন এবং এই রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরীক্ষা, কোলোনোস্কোপি এবং একটি মলের মধ্যে সুপ্ত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হতে পারে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
মলাশয় থেকে রক্তপাত কি একটি আপৎকালীন অবস্থা?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, রক্তপাত কোন চিকিৎসাগত আপৎকালীন অবস্থান নয়। তবু রোগী ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে মলাশয় থেকে রক্তপাত হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন। যদি মলাশয় থেকে রক্তপাতের চিকিৎসা না করা হয়, তবে রোগীর শ্বাসের প্রচণ্ড কষ্ট হতে পারে, জ্ঞান হারাতে পারে এবং পেটে ব্যথা হতে পারে।
কোলোনোস্কোপি কী এবং ডাক্তাররা একটি কী করে করেন?
কোলোনোস্কোপি হল একটি পরীক্ষা-পদ্ধতি যা ডাক্তাররা মলাশয় এবং মলদ্বারের পরিবর্তনকে পরীক্ষা করে। মলদ্বার এবং বৃহদন্ত্রের বহু রোগ নির্ণয় করা ছাড়াও এটি মলদ্বারের রক্তপাতের কারণ নির্ধারণ করতে সাহায্য করেন। ডাক্তার এই পরীক্ষাটি শেষ প্রান্তে ক্যামেরা বাঁধা একটি লম্বা সরু নল দিয়ে এই পরীক্ষাটি করেন। ডাক্তার এই নলটি ঢোকান এবং মলদ্বার ও মলাশয়ের অভ্যন্তরের দৃশ্য ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেন।
মলাশয়ের ক্যান্সার কি আরোগ্যযোগ্য?
যদি প্রথম ধাপে ধরা পড়ে তবে মলাশয়ের ক্যান্সার আরোগ্যযোগ্য। মলাশয়ের মধ্যে উপস্থিত পলিপ মলাশয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। ঝুঁকি কমানোর জন্য এই পলিপগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।