লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিস সাধারণভাবে এলিফ্যান্টিয়াসিস নামে পরিচিত। এটি একটি যন্ত্রণাদায়ক এবং অত্যন্ত বিকৃতিমূলক রোগ। ভারতে মশার কামড়ের ফলে এক ধরনের পোকার বিস্তারের মাধ্যমে অধিকাংশ সংক্রমণ (প্রায় ৯৯শতাংশ) ঘটে থাকে। একে লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসও বলে যেহেতু এটি লসিকাবাহগুলিকে আক্রমণ করে।
লসিকাবাহগুলি সারা দেহে উপস্থিত এবং লসিকা নামক একটি তরল পদার্থের মাধ্যমে অবাঞ্ছিত পদার্থগুলিকে দেহের বাইরে রেচিত করতে সাহায্য করে। লসিকাতন্ত্র দেহের তরলের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
প্রতি বছর ফিলারিয়াসিস অনেক মানুষকে আক্রান্ত করে। উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব এলাকা ছাড়া এটি ভারতের অধিকাংশ এলাকার বড়সড় জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা। এটি চীন, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেও ছড়িয়ে গেছে।
লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসের কারণ
- মশার কামড়ের মাধ্যমে লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিস একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যখন কোনো মশা লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই ব্যক্তির রক্তে ভাসমান আণুবীক্ষণিক পোকাগুলি মশাকে সংক্রামিত করে। যখন এই সংক্রামিত মশা অন্য কোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ায়, তখন আণুবীক্ষণিক পোকাগুলি (মাইক্রোফিলারি) ত্বকের মাধ্যমে ভেতরে ঢুকে যায় এবং সেই ব্যক্তির লসিকা বাহে পৌঁছে যায়। এই আণুবীক্ষণিক পোকাগুলি উক্ত ব্যক্তির লসিকা বাহে পূর্ণবয়স্ক হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পোকাগুলি প্রায় ৫-৭ বছর বেঁচে থাকে। এই পূর্ণবয়স্ক পোকাগুলি আবার নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে রক্তের মধ্যে লক্ষাধিক পোকার জন্ম দেয়। তাই যেসব ব্যক্তিদের রক্তে আনুবীক্ষণিক পোকা আছে, তাদের থেকে মশার মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
- ঊষা এবং গোধূলির মধ্যে মশার কামড়ে ফিলারিয়াসিস ছড়ায়।
- শহরীকরণ, দারিদ্র্য, খারাপ স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং মানুষের অভিবাসন এই রোগ ছড়ানোর জন্য মূলত দায়ী।
- পুরুষেরা মহিলাদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কারণ মহিলাদের তুলনায় তারা বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকেন।
লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসের উপসর্গ এবং লক্ষণ
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যখন সংক্রমণটি সদ্য ঘটে, তখন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। ব্যক্তিটি হয়ত জানতেই পারবেন না যে তার রোগটি হয়েছে।
- গুরুতর পর্যায়টি কিছু মাস থেকে কিছু বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং জ্বর, লসিকাবাহের প্রদাহ (লিম্ফ্যাঞ্জিটিস), লসিকা গ্রন্থিগুলির ফুলে যাওয়া এবং হাত, পা ও স্তনে উল্লেখযোগ্য ফোলা লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় পুরুষের যৌনাঙ্গ ফুলে যায়, একে হাইড্রোসিলি বলে যেখানে অণ্ডকোষ ফুলে থাকে এবং যন্ত্রণাদায়ক হয়। এই বর্ধিত অণ্ডকোষের কারণে ব্যক্তিটি অন্তর্বাস পরতে পারবেন না কারণ এতে চাপ বৃদ্ধি পাবে।
- প্রাথমিক আক্রমণের এক দশক বাদে গুরুতর পর্যায় শুরু হয়। এদতে শরীরের নানা অঙ্গ ফুলে যায় কারণ লসিকাবাহ তখন লসিকাকে নিষ্কাশন করতে পারে না। এই কারণে এটি কলার মধ্যে দলা পাকিয়ে যায় এবং এলিফ্যান্টিয়াসিস রোগ হয় যাতে বিশাল বিশাল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হয়। অপর একটি লক্ষণ হল লসিকা কাইলুরিয়া নামক পদার্থ লসিকার মাধ্যমে মূত্রের দ্বারা রেচিত হয়।
- সংক্রামিত ব্যক্তির অনাক্রম্যতা দুর্বল হয় কারণ তিনি কোনো সংক্রমণের বিরুদ্ধে তখন লড়াই করতে পারেন না। তাই তারা ত্বক ও লসিকা বাহের ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণপ্রবণ থাকেন।
- সুপ্ত ফিলারিয়াসিস নামক একটি রোগে ফিলারিয়াল পরজীবীদের প্রতি একটি উচ্চ সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এর কারণে ট্রপিক্যাল পালমোনারি ইওসিনোফিলিয়া রোগ হয়।
লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসের রোগনির্ণয়
ফিলারিয়াসিস প্রবণ এলাকায় বাস থাকলে লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসের সম্ভাবনা থাকে। ফিলারিয়াসিস হবার জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য অনেক মশার কামড়ের প্রয়োজন। তাই এতে ভ্রমণার্থীদের তেমন ঝুঁকি নেই।
লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসস নির্ণয়ের জনয তদন্ত
এই পরিক্ষার জন্য রাতে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয় কারণ রাতে পরজীবীরা রক্তে ব্যাপক সংখ্যায় উপস্থিত থাকে এবং দিনে খুবই কম দেখা যায়। যদি রক্তে মাইক্রোফিলারি দেখা যায়, তবে রোগনির্ণয় নিশ্চিত।
লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসের চিকিৎসা
ফিলারিয়াসিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধটি হল ডাইথাইলকার্বাম্যাজিন সাইট্রেট (ডিইসি)। এই ওষুধটি একজন ব্যক্তির শরীরের প্রাপ্তবয়স্ক পোকাগুলিকে মেরে ফেলতে পারে না কিন্তু এর অন্য ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণকে আটকে দিতে পারে। এটা এলিফ্যানটিয়াসিস এবং লিম্ফোডিমা (দেহের একটি অংশ ফুলে যাওয়া এবং এর কারণে তরল পদার্থ জমে যাওয়া) রোগকে সারাতে পারে না কিন্তু রক্তের মাইক্রোফিলারিকে মেরে ফেলে।
ব্যাপক ভাবে অনুমোদিত ওষুধের মাধ্যমে ডিইসি এই রোগপ্রবণ এলাকার মানুষদের নিখরচায় বছরে একবার করে দেওয়া হয়। এর ডোজগুলি শিশু এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়।.যেসব ব্যক্তিদের মাইক্রোফিলারি হয়, তাদের জ্বর, বমি, ফুসকুড়ি, চুলকানি, মাথা যন্ত্রণা ও সারাদেহ ব্যথা থাকে। গর্ভবতী মহিলাদের এই ওষুধ খাওয়া উচিৎ না। তবুও প্রসবের পরে এটা খাওয়া যেতে পারে।
হাইড্রোসিলির চিকিৎসায় তরল অপসারণ করে ব্যক্তিকে যন্ত্রণামুক্ত করা হয়।
যদি এলিফ্যান্টিয়াসিস হয়, ব্যক্তিটিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আক্রান্ত স্থানটিতে যদি কোনো ছোট অংশ কেটে যায়, তবে তাকে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে একটি অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম লাগাতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি না করা হলে সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে।
লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিসের প্রতিরোধ
- ঊষা এবং গোধূলির আগে সব জানালাগুলি বন্ধ করুন যাতে মশা প্রবেশ করতে না পারে।
- ঘুমোনোর সময় মশারি ব্যবহার করুন অথবা সমস্ত উন্মুক্ত অংশে মশানিরোধী ক্রিম ব্যবহার করুন।
- আপনার আশেপাশে জমা রাখবেন না কারণ জমা জলের মশার ডিম পাড়ে।
- বিশেষ করে ঊষা ও গোধূলির সময় আক্রান্ত এলাকায় হাত পা উন্মুক্ত না রাখাই ভালো। যথেষ্ট সুরক্ষার জন্য লম্বা হাতাযুক্ত জামা পরুন, সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যযুক্ত প্যান্ট এবং মোজা পরুন।