যখন কোন রোগীর দেহতন্ত্রকে সুস্থ করার জন্য অতিরিক্ত রক্তের প্রয়োজন হয়, সেই পদ্ধতিকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় রক্ত সঞ্চালন। রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলি যেমন, লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা, অনুচক্রিকাগুলিকে একজন রোগীর শরীরে একটি ইন্ট্রাভেনাস লাইনের (IV) মাধ্যমে সরাসরি সঞ্চালন করা যায়।
সাধারণত, যখন কোন ব্যক্তির কোন দুর্ঘটনা হয়, সার্জারির কারণে রক্তপাত হয় অথবা কোন নির্দিষ্ট রোগ থাকে, তখন তার অতিরিক্ত রক্ত প্রয়োজন হয়।
রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা
যেসব রোগীদের অতি শীঘ্র রক্তের প্রয়োজনীয়তা থাকে, তাদের অনেক মানুষ নিয়মিত রক্তদান করে থাকেন। এই দান করা রক্তকে খুবই সাবধানে সঞ্চয় করা দরকার, বিশেষত একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এবং একটি নির্দিষ্ট নকশাযুক্ত ব্যাগে একে রাখা উচিত।
যখন একজন ডাক্তার কোন রোগীর জন্য রক্ত সঞ্চালনের সুপারিশ করেন তখন তাদের শিরায় একটি সূচের মাধ্যমে রক্ত দেওয়া হয়। এর অপর প্রান্ত রক্ত বা রক্ত আছে এমন ব্যাগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সেই ব্যাগ থেকে রক্ত রোগীর শরীরের সংবহনতন্ত্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
Book An Appointment
কেন রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন?
এখানে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তার কিছু কিছু কারণ দেওয়া হল।
- সার্জারি: একটি বড় সার্জারিতে অনেক পরিমাণে রক্ত অনেক সময় বেরিয়ে যেতে পারে। তাই একে তৎক্ষণাৎ রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা উচিত।
- রক্তাল্পতা: যদি কোন রোগীর অত্যধিক রক্তাল্পতা থেকে থাকে, তবে তাদের শরীরে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি কমে যায়। এই ক্ষেত্রে তাদের জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হল তাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণে সতেজ লোহিত রক্ত কণিকা প্রবেশ করানো।
- ক্যান্সার: সাধারণত যেসব রোগীদের লিউকেমিয়া অথবা রক্তের ক্যানসার থাকে, তারা সাধারণত ব্যাপক রক্তাল্পতায় ভুগে থাকেন। এছাড়াও কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশনের কারণে অস্থি মজ্জার উপর বিপরীত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং তাদের লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তাই সঠিক সময়ে রক্ত সঞ্চালন করলে এই ক্যান্সারের রোগীদের বাঁচানো সম্ভব।
- অভ্যন্তরীণ রক্তপাত: আলসারের কারণে পরিপাক প্রণালীতে আঘাত বা অন্য কোনো পরিপাকজনিত রোগের কারণে ব্যাপক রক্তপাত হতে পারে। তাই সেই রোগীটির কখনো কখনো রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।
- দুর্ঘটনার কারণে আঘাত: যখন কোন ব্যক্তি একটি দুর্ঘটনার সময় প্রচন্ড আহত হন, তখন তার ক্ষতিগ্রস্ত রক্তবাহগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে রক্ত বেরিয়ে আসে। তাই সেই রক্তপাতকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ওই ব্যক্তির শরীরে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন আছে।
- গুরুতর অসুখ: কিছু নির্দিষ্ট রক্ত বাহিত রোগ যেমন সিকেল কোশ রোগ এবং হিমোফিলিয়ার জন্য অনেক সময় ক্রমাগত রক্তপাত হতে পারে। তাই এই জাতীয় রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য রক্ত সঞ্চালন করা অপরিহার্য হতে পারে।
রক্ত সঞ্চালনের বিভিন্ন প্রকারভেদ
রক্ত সঞ্চালনের অনেক রকম প্রকারভেদ আছে। তাদের মধ্যে কিছু হল:
- লোহিত রক্তকণিকা সঞ্চালন: এই ধরনের রক্ত সঞ্চালন সবচেয়ে সাধারণ, কারণ যারা রক্তাল্পতা বা অন্যান্য রোগে ভুগছেন, তাদের কেবল লোহিত রক্ত কণিকার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন থাকে। লোহিত রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিন থাকে যার কারণে রক্তের রং লাল হয় এবং এটি অক্সিজেন পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। যে সমস্ত রোগীদের সার্জারি করা হয়, তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে লোহিত রক্ত কণিকার প্রয়োজন।
- অনুচক্রিকা সঞ্চালন: অনুচক্রিকা হলো রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা রক্ত তঞ্চনে সহায়তা করে এবং অতিরিক্ত রক্তপাতে বাধা দেয়। অনুচক্রিকার সঞ্চালন মূলত ক্যান্সারের রোগীদের জন্য প্রয়োজন হয়, কারণ তাদের অনুচক্রিকার সংখ্যা প্রায়শই গড় মাত্রার থেকে অনেক নিচে নেমে যায়।
- প্লাজমা সঞ্চালন: রক্তের প্লাজমা অংশ অথবা তরল অংশে একপ্রকার প্রোটিন থাকে যা রক্ত তঞ্চনের জন্য দায়ী। সাধারণত প্লাজমা সমস্ত রক্তের উপাদানের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং সর্বাধিক এক বছরের জন্য একে ক্রায়ো-অধঃক্ষেপিত পদার্থে পরিণত করে সঞ্চয় করে রাখা যায়। প্লাসমাফেরেসিস হল প্লাজমা দানের একটি পদ্ধতি যাতে রক্ত থেকে কেবল প্লাজমাকে পৃথক করা হয় এবং অবশিষ্ট রক্তের উপাদান গুলিকে দাতার শরীরে পুনরায় প্রেরণ করা হয়।
রক্ত সঞ্চালন এর সুবিধা
যখন রক্ত সঞ্চালনের ফলে আপনার শরীরে লোহিত রক্ত কণিকার স্বাভাবিক সংখ্যা ফিরে আসে, তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে আপনার শরীরের কোশগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ হচ্ছে। যথেষ্ট পরিমাণে লোহিত রক্তকণিকা থাকার অর্থ হল একটি সুস্থ হৃদপিণ্ড থাকা।
- যেহেতু একটি ক্ষতস্থান থেকে অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধ করার জন্য স্বাভাবিক অনুচক্রিকার সংখ্যা অপরিহার্য। তাই অনুচক্রিকার সঞ্চালন অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাতকে প্রতিরোধ করতে পারে।
- যখন রক্ত স্বাভাবিকভাবে তঞ্চিত হতে পারে না, তখন ক্রায়ো-অধঃক্ষেপনের প্লাজমা সঞ্চালন রক্তপাত বন্ধ করে।
রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতির ঝুঁকিগুলি
অনেক রোগীর জ্বর হয় যা রক্তসঞ্চালন শেষ হবার 5 ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। অনেকের বুকে ব্যথা অস্বস্তি এবং গা বমি বমি লাগতে পারে এবং তাদের দেহের উষ্ণতা বেশি থাকতে পারে।
- রক্তের শ্রেণী মিলে গেলেও কিছু কিছু লোকের রক্ত সঞ্চালনে অ্যালার্জি থাকতে পারে। তাই সঞ্চালনের সময় বা তার কিছুক্ষণ পরেই তাদের চুলকানি হতে পারে বা তাদের শরীরে অ্যালার্জির লক্ষণ হিসেবে আমবাত হতে পারে।
- যদি শরীর নতুন নেওয়া রক্তকে স্বীকার না করে, তবে জটিল অনাক্রম্য হিমোলাইটিক প্রতিক্রিয়া দেখা হতে পারে। তখন যতক্ষণ না চিকিৎসা করা হচ্ছে, রোগীর শরীরে নানারকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন, জ্বর, পিঠের পিছনের দিক ব্যথা হওয়া, শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব এবং কালো মূত্র।
- রক্তসঞ্চালন পদ্ধতি হয়ে যাবার অনেক পরে বিলম্বিত হিমোলাইটিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এর উপসর্গগুলি জটিল অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ।
- যদি রক্ত সঞ্চালনের আগে রক্তকে সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষার না করা হয় তবে রোগীটি ইটিস-পিটিস অথবা কোন ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। রক্তের মাধ্যমে জাইকা ভাইরাস এবং পশ্চিম নীল ভাইরাস সঞ্চালিত হতে পারে যদিও এই ধরনের ঘটনা বিরল।
- রক্ত সঞ্চালনের ঠিক পরে একটি অ্যানাফিলাক্টিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এটি একজন রোগীর জন্য প্রাণঘাতীও হতে পারে। এর ফলে মুখ ফুলে যেতে পারে, গলা ব্যথা হতে পারে, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হতে পারে এবং হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি আগে আপনি কী কী প্রস্তুতি আশা করতে পারেন?
যদি আপনার রক্ত সঞ্চালনের কথা থাকে তবে একজন নার্স আপনার রক্তচাপ, নাড়ির স্পন্দন এবং দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে দেখবেন যে আপনি সুস্থ আছেন কিনা। ডাক্তার দাতার রক্তও পরীক্ষা করে দেখবেন যে তা আপনার শরীরের পক্ষে সুরক্ষিত কিনা।
রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ করতে কতক্ষণ সময় লাগে?
রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতিটি নির্ভর করে কীরকম ঘনত্বের রক্ত রোগীর দেহে সঞ্চালিত হবে, তার উপর। যে রোগীর শরীরে রক্ত সঞ্চালন হবে, তার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেন যে তার শরীরে কতটা পরিমাণে রক্ত সঞ্চালিত করতে হবে।
রক্ত সঞ্চালনের জন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি আছে?
কিছু কিছু ওষুধ আপনার শরীরের রক্ত উৎপাদনের পদ্ধতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কিন্তু যদি অতিরিক্ত পরিমাণে রক্তপাত হয়, তবে তৎক্ষণাৎ রক্ত দিতে হবে, নয়তো রোগীর খুবই ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে, এমনকি মৃত্যুরও সম্ভাবনা আছে।